এক সময়ের সবুজ-শ্যামল ঢাকা শহর। প্রতিটি গলিতে গন্ধ ছিল কদম-শিউলির। অথচ আজ সেই বাতাসে নিশ্বাস নেওয়াও কষ্ট। আপনি সকালে হাঁটতে বের হলেন, অথচ মনে হলো যেন ধোঁয়ার চাদরে মোড়ানো কোনো কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। চোখ জ্বলে, গলা শুকায়, বাচ্চারা কাশে। আপনি একা নন—এই অনুভূতি এখন ঢাকার লাখো মানুষের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
IQAir-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা একাধিকবার শীর্ষ ২-এর মধ্যে উঠে এসেছে। WHO জানায়, ঢাকার বাতাসে PM2.5 কণিকার পরিমাণ WHO অনুমোদিত মানের প্রায় ৮ গুণ বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই দূষণ তৈরি হচ্ছে কোথা থেকে? আর আমরা কি এই দূষণ থেকে রক্ষা পেতে পারি?
বায়ু দূষণের মূল উৎস কোথায়?
১. ইটভাটা: চারপাশে ছড়ানো ধোঁয়ার কারখানা
ঢাকার আশপাশে হাজারো ইটভাটা, যেগুলোর অনেকই এখনো পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এগুলোতে কাঠ, কয়লা এবং আবর্জনা পুড়িয়ে চালানো হয়, যা থেকে নির্গত হয় বিপজ্জনক ব্ল্যাক কার্বন এবং PM2.5 কণা। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে সূক্ষ্ম কণার (PM2.5) প্রায় ৫৮-৬০% উৎস এই ইটভাটাগুলো।
২. যানবাহনের ধোঁয়া: চলন্ত দূষণযন্ত্র
ঢাকায় চলাচলকারী বহু পুরনো বাস, ট্রাক এবং লেগুনা—বেশিরভাগই ডিজেলচালিত। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন চালু থাকা অবস্থায় এই যানবাহন থেকে নির্গত হয় কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার অক্সাইড। এতে দূষণ শুধু রাস্তার মধ্যেই নয়, ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরে।
৩. নির্মাণ কাজ ও ধুলাবালি
নগরজুড়ে নির্মাণ চলছে—আবাসিক ভবন, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্মাণসামগ্রী খোলা রাখা হয়। বাতাসে উড়ে বেড়ায় সিমেন্ট, বালু ও মাটি। এতে সাধারণ পথচারী, এমনকি আশেপাশের বাসিন্দারাও পড়েন শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত ঝুঁকিতে।
৪. শিল্প-কারখানার নির্গমন
টেক্সটাইল, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ, প্লাস্টিক শিল্প থেকে নির্গত ধোঁয়া ও রাসায়নিক বর্জ্য ঢাকার বায়ুকে বিষাক্ত করে তোলে। এসব কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
৫. জৈব বর্জ্য পোড়ানো
রাস্তায়, মাঠে বা বাসার পেছনে অনেকে পলিথিন, কাগজ ও খাবারের বর্জ্য আগুনে পোড়ান। এতে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, তা কেবল দূষণই করে না, বরং স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ায়।
৬. নিয়ন্ত্রণের অভাব
বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষা আইন থাকলেও তার বাস্তবায়নে রয়েছে ঘাটতি। অনেক সময় লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা, দূষণকারী কারখানা বা অস্বাস্থ্যকর নির্মাণ কার্যক্রম নির্ধারিত দণ্ড ছাড়াই চালু থাকে।
এই দূষণ আমাদের শরীরে কী করছে?
বায়ু দূষণের প্রভাব শুধু বাইরের পরিবেশে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে আমাদের শরীরের ভেতরে।
- শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এলার্জি
- হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ
- শিশুদের মস্তিষ্ক ও শারীরিক বিকাশে বাধা
- বৃদ্ধদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস
- মানসিক চাপ ও একাগ্রতার অভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে PM2.5 কণা শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে রক্তে মিশে যায় এবং একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি করে।
ঢাকাবাসীর জীবনে বাস্তব প্রভাব
মহল্লায় খেলা করা বাচ্চারা এখন ছাদে উঠে মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে থাকে। স্কুলগামী শিশুরা কাশতে কাশতে ক্লাসে যায়। অনেক পরিবার সকালে দরজা-জানালা খোলা রাখে না কারণ বাইরে ধুলোর আস্তরণ। শুধু ২০২১ সালেই—বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষ। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই ভয়াবহ তথ্য।
তাহলে করণীয় কী?
সরকারিভাবে:
- ইটভাটা আধুনিকীকরণ (zigzag kiln বাধ্যতামূলক)
- পুরনো যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন বাতিল ও ই-গাড়ির প্রসার
- নির্মাণস্থলে ধুলা নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো ও কাভার বাধ্যতামূলক করা
- কারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ইউনিট গঠন
নাগরিক পর্যায়ে:
- মাস্ক ব্যবহার ও Air Quality চেক করা অভ্যাসে পরিণত করা
- রাস্তায় বা বাসায় বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ রাখা
- গাছ লাগানো ও ছাদে বাগান তৈরি
- শিশুর যত্নে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা
ঢাকার বাতাসে বিষ মিশে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রেখে যাব একটি শ্বাসরুদ্ধকর শহর। আমাদের উচিত, শহরের প্রতিটি শ্বাসকে নিরাপদ করতে ছোট ছোট পদক্ষেপ নেওয়া—আজ থেকেই। একটু সচেতনতা, একটু দায়িত্ব—এই দুই মিললেই ফিরতে পারে ঢাকার পুরনো পরিচয়: প্রাণবন্ত, শ্বাসযোগ্য এক নগরী।
তথ্যসূত্র:
- ঢাকার বায়ু দূষণ | বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর আজ ঢাকা
- ঢাকা যে পাঁচ কারণে বায়ু দূষণে শীর্ষেই থাকছে - BBC News বাংলা
- ঢাকাসহ দেশের কোন কোন শহরে দূষণ বেশি, কারণ কী | প্রথম আলো
- ঢাকায় গত ৯ বছরে মানুষ মাত্র ৩১ দিন নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে
- The Causes of Air Pollution in Dhaka City, Bangladesh – Smart Air
- Bangladesh Air Quality Index (AQI) and Air Pollution information | IQAir